বিয়েতে গায়ে হলুদ নিয়ে এই কন্টেন্টটি সম্পূর্ণ তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার নিজস্ব। তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার পূর্ববর্তী অনেকগুলো ব্লগ হুবহু কপি করে অনেক ম্যাট্রিমনি সাইটে পাবলিশ করা হয়েছে, এ ব্যাপারটি আমাদের নজরে এসেছে। উক্ত ম্যাট্রিমনি সাইটের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই ব্লগের সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ কপি করে অন্য কোনো সাইট বিশেষ করে যেকোনো ম্যাট্রিমনি ব্লগে পাবলিশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিয়ের মৌসুম মানে শীতের মৌসুম প্রায় শেষ। চারদিকে এখন বিয়ের ধুম লেগেছে। বিয়ের আয়োজনের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হলো গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদ এর উৎসব হলো রঙ আর ছন্দের মেলা। গায়ে হলুদ এর দিন থেকেই উৎসবের রূপ নেয় বিয়েবাড়ি। আগের দিনের দাদী-নানীদের বিয়ের গীত এর বদলে এখন ডিজে গানে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে পুরো বাড়ি। গায়ে হলুদ এর উৎসব ঘিরে অনেক তোড়জোড় আর হৈ-হুল্লোড় থাকে। গায়ে হলুদ কিভাবে এলো এবং বিয়েতে গায়ে হলুদ এর সাজ নিয়েই আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করবো।
গায়ে হলুদ আসলে কি?
গায়ে হলুদ বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। বর-কনের দাম্পত্য জীবনকে যেকোনো ধরনের অকল্যাণ বা অপশক্তি থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই গায়ে হলুদ এর অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বৈদিক যুগ থেকে ভারতীয় হিন্দুসমাজে গাত্রহরিদ্রা বা অধিবাস বিয়ের অনুষ্ঠানের অবশ্য পালনীয় শাস্ত্রাচার ও লোকাচার হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের পর তারাও আচার-অনুষ্ঠানে দেশিয় রীতিপদ্ধতি অনুসরণ করে। গায়ে হলুদ এর অনেকগুলো রীতি মূলত মঙ্গোলীয় এবং অন্যান্য আদিবাসী উপজাতি থেকে এসেছে।
অনুষ্ঠানে হলুদ ছাড়াও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহৃত হয় ধান, দুর্বা, তিল, যব, সরিষা, মাষকলাই, সোন্দা, মেথি, গিলা, সুঁট, চন্দন, সিঁদুর, মেহেদি, মিষ্টি, মাছ, পঞ্চপ্রদীপ প্রভৃতি।
আদর্শ জীবনসঙ্গী খুঁজতে
গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানটি বর ও কনের বাড়িতে আলাদা আলাদাভাবে পালন করা হয়। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে গায়ে হলুদের উপকরণ নিয়ে যাওয়া হয়। দু বাড়িতেই গায়ে হলুদ এর অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা হয় সুসজ্জিত মঞ্চ বা স্টেজ। আনুষ্ঠানিক আচার পালনের জন্য গায়ে হলুদের উপকরণগুলি ডালা-কুলায় রাখা হয়। মা, দাদী, নানী এবং অন্যান্য স্থানীয় মুরুব্বিরা প্রথমে বর-কনের কপালে হলুদ মাখান। এ সময় তাদের মিষ্টি খাওয়ানো হয়। অতিথিদের বিশেষ খাবার ও মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। পরে বর-কনের সারা শরীরে হলুদ মাখানো হয়।
গায়ে হলুদ কিভাবে এলো?
ঐতিহাসিকরা বলেন, বর্তমান বিয়ের রীতি অনেকটাই মোঘল যুগ থেকে চলে আসছে। ইতিহাস বলে, আগে নিয়ম ছিল সূচের ছোঁয়া নেই এমন পোশাক পরেই বিয়ে হবে। পরে মোঘল সম্রাট জাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান জরির সুতার তৈরি বেনারসির প্রচলন করেন। ইতিহাসবিদরা বলছেন, বিয়েতে গায়ে হলুদের প্রচলন কোন ধর্মীয় কারণে নয় বরং বেশ কিছু উপকারী দিকের কথা ভেবেই শুরু হয়।
হিন্দু বিয়ের রীতি অনুযায়ী, বিয়ের দিন সকালে হলুদ মেখে স্নান করেন বর-কনে। পুরাণেও হিন্দু বিয়ের রীতিতে গায়ে হলুদের চল ছিল। বিয়ের সবথেকে জাকজমকপূর্ণ অংশটা হচ্ছে গায়ে হলুদ।
গায়ে হলুদ কোন ধর্মের সংস্কৃতি?
এখনকার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের অনুসারীরাই বিয়েতে গায়ে হলুদ এর আয়োজন করে থাকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, বিয়ের মাধ্যমে যেহেতু একজন নারী পিতার বংশ ছেড়ে স্বামীর বংশে চলে আসে, সেজন্য একজন নারীর পক্ষে বিয়ে চরম একটা সন্ধিক্ষণ। বিয়েতে যাতে কোন বাধা-বিপত্তি না ঘটে তার উদ্দেশ্যেই হরিদ্রাগণপতির পূজা করে থাকে।
হরিদ্রাগণপতি মানে হলুদ গণেশ, হিন্দু দেবতা গণেশের একটি রূপ যার গায়ের রং হলুদ। পার্থিব চাহিদা পূর্ণ করার জন্য তার পূজা করা হয়। তাই হিন্দু সমাজ কল্যাণের আশায় বিয়ের সময় হলুদ কাপড় পরিধান করে এবং গায়ে হলুদ মাখে। যা হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি হিসাবে পালন করে থাকে।
গায়ে হলুদ আসলে ইসলামী কোন সংস্কৃতি না। কিন্তু এটা করলে গুনাহ হবে এমনটাও বলা হয় নি। আবার গায়ে হলুদ ইবাদতের বিষয়ও নয়। এটা হচ্ছে এক ধরনের স্থানীয় রীতি বা প্রচলিত সামাজিক আচার। ইসলামের আলোকে এটাকে না দেখাই উত্তম হবে।
ইসলামে হলুদ একটি পছন্দনীয় রঙ। বিয়ের সময় গায়ে হলুদ মাখানো, হলুদ রঙের জামা পরা এবং সুগন্ধি ব্যবহারের অনুমতি আছে। কেননা আবদুর রহমান ইবন আওফ (রাঃ) হলুদ লাগিয়ে রাসূল (সঃ) সম্মুখে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (সঃ) তা অপছন্দ করেন নি এবং তিরস্কারও করেন নি ।
অন্য একটি হাদিসে হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সমস্ত রং ও বর্ণের মধ্যে হলুদ বর্ণই হলো উত্তম ও সুন্দর। তবে অবশ্য ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী ও তাঁদের সঙ্গী ও সাথীর মতে হলুদ কাপড় কিংবা জাফরানের রঙ লাগানো মাখরুহ। তবে বর্তমানে যেভাবে গায়ে হলুদ করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ নাযায়েজ। মোমবাতি জ্বালানো, গায়রে মাহরামরা গায়ে হলুদ লাগিয়ে দেয়া, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, যুবতীদের সাজগোজ় করে সৌন্দর্য প্রদর্শন, নিষিদ্ধ বাদ্য বাজানো, অশ্লীল গান এসবই হারাম। গায়ে হলুদ এর নামে এইসব করা ইসলামি সংষ্কৃতির অংশ নয়।
গায়ে হলুদ বনাম ইসলাম
বিয়ে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর একটি সুন্নত। নবী কারীম (সা) বলেন-
বিবাহ আমার একটি সুন্নত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হবে, সে আমার উম্মত নয়
তাই বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো রাসুল (সা) এর সুন্নত মোতাবেক পরিচালনা অবশ্য কর্তব্য। আমাদের সমাজে এখন বিয়ের অনুষ্ঠানে যে ইংরেজী, হিন্দি, বাংলাসহ বিভিন্ন অশ্লীল গান বাজানো হয় তা নিতান্তই গর্হিত কাজ ও কবিরা গোনাহের পাশাপাশি কুফুরীতে পরিণত হতে পারে।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েকে মঞ্চে সাজিয়ে রেখে বসিয়ে রাখা হয়। আর মেয়ে পক্ষের এবং ছেলে পক্ষের আত্মীয়-স্বজনরা মেয়ের শরীরে হলুদ মাখিয়ে দেন। সুতরাং লক্ষ্য রাখা উচিত যে, গায়রে মাহারামগণ যেন বর ও কনেকে স্পর্শ করতে না পারে।
এছাড়া বিয়ের পরদিন সকালে বর ও কনেকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে সকল মাহরাম ও গায়রে মাহরামগণের সামনে বেহায়াপনাভাবে গোছল করানো হয়। আর এই গোছলের সময় ছোট-বড় সকলেই রং, কাদা-মাটি ও মরিচ মিশ্রিত পানি নিয়ে অপরের দেহে ছিটিয়ে উল্লাস করে যা আসলে ইসলাম পরিপন্থী।
গায়ে হলুদ এর উপকারিতাগুলো কি?
ডাক্তাররা বলেন, কাঁচা হলুদ জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে, এছাড়া হলুদের রয়েছে রোগ সংক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতাও। হলুদ শরীরকে পরিষ্কার করে ও সংক্রমণ ঠেকায়। কাঁচা হলুদ শরীরে তাপের ভারসাম্য রাখে ও শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। হিন্দু ধর্মে হলুদকে শুভ ও মঙ্গলদায়ক বলে মনে করা হয়।
হলুদ ব্যবহার করলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে। সঙ্গে ত্বকের যে কোনও সমস্যাকে ঢেকে রাখতে পারে এই হলুদ। ভারতীয় রূপচর্চায় প্রাকৃতিক উপাদানের অন্যতম ছিল এই হলুদ। হলুদের অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল ক্ষমতা যে কোনও ত্বকের জন্যই উপকারী। চড়া মেক আপেও ত্বকের ক্ষতি করতে দেয় না।
অনেকের আবার বলেন, হলুদ এর স্নিগ্ধতা মনকে শুদ্ধ করে। এতে বর ও কনের মধ্যে বিয়ে ভীতি দূর হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে হলুদ ব্যবহারে বিবাহের আগের ক্লান্তি রোধ করতে সহায়তা করে। হলুদে মাথা ব্যথা, দেহের প্রদাহ এবং উদ্বেগের প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। মনকে শান্ত করার জন্যও এটি দুর্দান্ত উপাদান।
গায়ে হলুদ এর উপকরণ
গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ডালা-কুলা সাজিয়ে বর এবং কনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বর এবং কনের জন্য আলাদাভাবে ডালা সাজতে হয়। এমনভাবে ডালা সাজাতে হয়, যাতে প্রয়োজনীয় প্রসাধন একসঙ্গে হাতের কাছে থাকে। গায়ে হলুদের ডালা কাগজের বা সাটিন কাপড়, নেট, ড্রাইফুল, কাপড়ের ফুল, লেস ইত্যাদি দিয়ে সাজানো যেতে পারে। ডালার মধ্যে পান-সুপারি সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে হবে। মিষ্টি নিতে হবে আলপনা করা হাঁড়িতে।
বর্তমান সময়ে গায়ে হলুদের পোশাক কেমন হবে, তার ওপর ভিত্তি করে হলুদের ডালা-কুলা সাজানো হয়। মাছের ও পোশাকের ডালা সেলোফেন পেপার এবং নানা রঙের নেটের কাপড় পেঁচিয়ে চারপাশে সোনালি রঙের ফিতা দিয়ে বেঁধে সাজানো হয়। বরের ডালায় থাকে পোশাক, জুতা, টুপি, সুগন্ধি ইত্যাদি।
গায়ে হলুদ এ খাবার মেনু
শহরে এখন গায়ে হলুদের সব আয়োজন রাতেই করা হয়। গায়ে হলুদে বর ও কনের সামনে নানা পদের ফুল ও ফল দিয়ে তৈরি ডিজাইন করে সাজানো বিভিন্ন খাবার আইটেম রাখা হয়। গায়ে হলুদের খাবারের তালিকায় অতিথিদের জন্য তেহারি কিংবা বিরিয়ানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিরিয়ানির সঙ্গে টিকিয়া কাবাব দেওয়া যেতে পারে। অতিথিদের খাবারের শেষে মিষ্টির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া এর সাথে অতিথিদের জন্য আরো কিছু হালকা খাবারের ব্যবস্থা করা যায় যেমন চটপটি, ফুচকা, গরম গরম জিলাপি, ঝালমুড়ির মতো মজাদার সব খাবারের ব্যবস্থাও দেখা যায়। গায়ে হলুদের আপ্যায়নের সবচেয়ে পুরনো রেওয়াজ হচ্ছে পান। সুতরাং অনুষ্ঠানে পানের আয়োজন করতে ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু!
নাচ-গান, আরো যত আয়োজন
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে প্রফেশনাল ডিজে ডেকে নাচ-গানের পাশাপাশি আজকাল বর-কনেকেও নাচে পারফর্ম করতে দেখা যায়। এছাড়া বর-কনের বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন, কাছের আত্মীয়-স্বজনদের পারফরম্যান্স তো থাকেই। কম বয়সীদের পাশাপাশি মুরব্বিরাও যেন নাচে অংশ নিতে পারেন, সেরকম গান রাখুন তালিকায়।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আরেকটি আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে রং খেলা। রং খেলা না হলে গায়ে হলুদ পরিপূর্ণ হয় না। এছাড়া মিউজিক্যাল চেয়ার, পিলো পাসিংয়ের মতো মজার মজার খেলার মাধ্যমে জমিয়ে রাখতে পারেন বিয়ের আগের এই দিনটি।
শেষ কথা
বর্তমানে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে গায়ের হলুদের আয়োজনেও এসেছে ভিন্নতা। সাধারণত বর আর কনের গায়ে হলুদের আয়োজন আলাদা ভাবে হয়ে থাকলেও বর ও কনের গায়ে হলুদ একইসাথে একই জায়গায় করা হয়। এতে করে খরচ কিছুটা বাঁচে।
কল করুনঃ+880-1407-004393 অথবা +88-01782-006615 এ।
আমাদের মেইল করুন taslima55bd@gmail.com