লাভ ম্যারেজ না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, কোন বিয়েতে বেশি সুখ? এ দ্বন্দ্ব চিরকালের। ধর্মীয় মতে, জীবনসঙ্গী স্বর্গ থেকেই তৈরি হয়ে আসে। অর্থাৎ, আপনার সঙ্গে কার বিয়ে হবে, তা আল্লাহ পাক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। তবে এটাও সত্যি যে প্রত্যেক ছেলে-মেয়েই তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে ছেলেবেলা থেকে একটা স্বপ্ন দেখে থাকেন।
দুটি সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবার, কেউ কাউকে কখনো দেখেনি বা চেনেও না, একদিন হঠাৎ দুটো অচেনা পরিবারের লোকজন একে অন্যের বাড়িতে এসে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ সাধারণত এভাবেই হয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের যুবক-যুবতীরা পরিবারের পছন্দের ছেলেমেয়ের পরিবর্তে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করতে বেশি পছন্দ করেন। আজকে আমরা জানবো লাভ ম্যারেজ নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, কোন বিয়েতে রয়েছে বেশি সুখ?
লাভ ম্যারেজ কেন করবেন?
একটা সময় ছিল যখন বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করতেন। তবে তেমনটা এখন খুব কমই দেখা যায়। কারণ এখন অনেক ছেলেমেয়েই লাভ ম্যারেজ করছেন।
পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস
যেকোনো সম্পর্কের মূল ভিত হলো বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া কখনো সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়৷ লাভ ম্যারেজ করলে প্রেম করার সময়েই পরস্পরের বিশ্বাস অর্জন করার সময় পাওয়া যায়। আবার একে-অপরের প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া বা পাওয়ারও যথেষ্ট সুযোগ থাকে৷ সুযোগ থাকে অন্যজনের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানারও৷
আদর্শ জীবনসঙ্গী খুঁজতে
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে বিয়ের পর অনেক দম্পতির মধ্যে অতীতের কোনো ঘটনা বা অতীতের কিছু নিয়ে ঝগড়া লেগে যেতে পারে। তবে লাভ ম্যারেজ করলে অতীতের সব ব্যাপার আগে থেকেই জানা হয়ে যায়। ফলে জীবনযাপন অনেক সহজ হয়।
ভুল-ত্রুটি বা দূর্বলতা
প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই থাকে নানারকম ভুল-ত্রুটি বা দূর্বলতা৷ লাভ ম্যারেজ এ যেহেতু অনেকদিন ধরে জানা-শোনা থাকে তাই শারীরিক বা সংসারের যেকোন সমস্যার কথা সহজেই মন খুলে বলা যায়। এক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানও সহজ হয়। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ ধরনের সমস্যা প্রায়শই দম্পতিদের মধ্যেই হতাশার জন্ম দেয়। আবার অনেক সময় অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ দৈনন্দিন চাহিদার কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন মেয়েরা। কিন্তু লাভ ম্যারেজ হলে সেই ব্যাপারটা থাকেনা। এছাড়া যেকোনো বিষয়ে খোলাখুলি কথাবার্তার ক্ষেত্রে দম্পতিরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
ভালো লাগার বিষয়
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ বিয়ের পর অনেকটা সময় চলে যায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে৷ আর এইটুকু সময়ে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ বুঝে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের খবর নেয়ার তেমন সুযোগ পান না তাঁরা৷ কিন্তু বিয়ের আগে প্রেম বা বন্ধুত্ব থাকলে দুজনের পছন্দ-অপছন্দ আগে থেকেই জানা থাকে, ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে কম আর দাম্পত্যজীবনও হয় মধুময়৷ নতুন করে কিছু শিখতে হয় না বা শেখাতেও হয় না।
লাভ ম্যারেজ এ যেসব বিষয় জানা জরুরি
১. লাভ ম্যারেজে এর ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে যদি দুটি আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে অর্থাৎ যদি পাত্র ও পাত্রীর জাতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি আলাদা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কিছু বাধা আসতে পারে। এক্ষেত্রে উভয়েরই উচিত একে অপরের পাশাপাশি উভয়ের পরিবারকেও সমানভাবে গ্রহণ করা।
২. বিয়ের পর দুজনেই পরিবারের অন্য সদস্যদের যত্ন নেবেন, সবার সঙ্গে মানিয়ে চলবেন। অনেক সময় ইচ্ছা না করলেও আপনাকে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন সম্পর্ক ও বিবাহিত জীবনের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাই ধৈর্য ধরার পাশাপাশি প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে।
৩. একে অপরের সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করুন। সঙ্গীর ঐতিহ্য গ্রহণ করা ভালো। তবে নিজের শিকড়কে কখনই ভুলে যাবেন না। সবচেয়ে বড় কথা হলো সমাজের সব কথায় কান দেবেন না। কারণ সমাজে লাভ ম্যারেজ সম্পর্কে মানুষের মানসিকতা খুব একটা ভালো নয়।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এর সুবিধা
এখনও অনেক পরিবার আছে যারা পারিবারিকভাবে বিয়ে করাটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনেকে মনে করেন যে, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ তাদের পক্ষে কার্যকর হবে না। তবে এমনটাও অনেক সময় হয় যে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ আপনি আপনার আসল সঙ্গীকে খুঁজে পেলেন, ঠিক যেরকমটা আপনি চাইছিলেন।
পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি
সাধারণত পিতা-মাতারা তাদের সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা- মন্দলাগা সবকিছু সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানেন। তাই পারিবারিকভাবে বিয়ের ক্ষেত্রে পিতা-মাতারা তাদের সন্তানের জন্য পছন্দসই সেরা জীবনসঙ্গীর সন্ধান করতে পারেন। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বা পারিবারিক বিয়ের ক্ষেত্রে দুটি পরিবার এবং পারিবারিক সকল কিছু দেখেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে পরস্পরের পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে আলাদা একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই বিয়ের ফলে দুটো পরিবারের মানুষ একসঙ্গে তাঁদের আবেগ অনুভূতি সুখ দুঃখ ভাগ করে নেন। ফলে পাত্র-পাত্রী এবং দুটি পরিবারের একে অপরের সাথে মানিয়ে নিতে খুব বেশি কষ্ট হয় না। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ সম্পর্ক গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় প্রেমের বিয়ের চাইতেও।
তাছাড়া পাত্র-পাত্রীর মধ্যে যদি কখনও কোনও সমস্যা হয় তাহলে দুটি পরিবারই এগিয়ে আসে সেই সমস্যার সমাধানে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ পরিবারের পাশাপাশি সমাজও যেকোন প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়ায়।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান
পারিবারিক বিয়েতে পাত্র-পাত্রী দুটি ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেন। এখানে স্বাভাবিকভাবেই পাত্র-পাত্রী একে অপরের প্রতি নিজেদের শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেন। কারণ এখানে শুধু দুজনের মান-সম্মান নয় বরং দুটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কথা চিন্তা করতে হয়। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলে পরিবারের সদস্যগণ খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের নতুন সদস্যকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেন। এতে সকলের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বজায় থাকে। লাভ ম্যারেজে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলেও কোনো না কোনোভাবে ঝামেলা তৈরি হয়ে গেলে দুজনের মনোমালিন্য অনেকাংশেই দুজনের সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয় ও সম্পর্কে চির ধরতে থাকে।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ দীর্ঘস্থায়ী হয়
পারিবারিক বিয়েতে ছেলে-মেয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিয়ের আগে খুব কমই পরিচিত থাকেন। বিয়ের পর যতদিন যেতে থাকে তারা আস্তে আস্তে একে অপরকে চিনতে পারেন। এতে সঙ্গীকে রোজ নতুন ভাবে জানা যায়। এবং নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া তৈরি করে আনন্দের মুহূর্ত। আপনার জীবনে যদি কোনও ভয়ঙ্কর অতীতও থাকে, তাহলে তা আপনার বিবাহিত জীবনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে আপনি নতুন জীবন শুরু করতে পারেন।
লাভ ম্যারেজ এ একে পরস্পরের প্রতি আশা-ভরসা বেশি থাকে যা পূরণ না হলে অনেক সময় মান অভিমান পর্ব অনেকটা দূর গড়ায়। অনেক সময় প্রেমিক-প্রেমিকা ভাবেন প্রেম করার পরও সে কেন তার সমস্যা বুঝতে পারছে না বা এখনো এতো ছাড় কেন দিতে হবে। আর এতেই সমস্যা শুরু হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করলে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলবেন
১. অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ আপনার অতীতের সম্পর্কের কথা প্রথম সাক্ষাতেই বলবেন না। এতে অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। আবার আপনি বিয়ে নিয়ে কী ধরনের স্বপ্ন দেখেন, তা সঙ্গীর সাথে আলাপ করে নেবেন শুরুতেই। আপনি ধুমধাম করে বিয়ে নাকি সিম্পল বিয়ে চান সেটা প্রথম থেকেই শেয়ার করবেন।
২. বিয়ের পর কটা বাচ্চা চান বা না চান সেটা আগে থেকেই আলোচনা করে নেয়া ভালো। আবার বাবা-মায়ের সাথে থাকতে চান কি চান না এটা আলোচনা না করাই ভালো। অর্থাৎ হাবভাবে বুঝিয়ে দিন আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনাটা কী?
৩. আপনার মধ্যে কোনো খারাপ অভ্যাস থাকলে হবু স্ত্রী বা স্বামীকে অবশ্যই বলতে হবে। এবং এই প্রসঙ্গে তার মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি কী সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। তবে প্রথম সাক্ষাতেই ভার্জিনিটি নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ছোট্ট কিছু পরামর্শ
মনে রাখবেন যে কোন সম্পর্কেই ওঠা-পড়া থাকে। লাভ ম্যারেজ হোক বা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, বিয়ের পর ঝগড়া যে কোনও দাম্পত্যের অংশ। তবে সবসময় ঝগড়া করে নয়, কিছু সময় নরম ভাবে নিজের বক্তব্য বলবেন। সবসময় ঝগড়ার মেজাজে থাকবেন না। তাছাড়া নিজেদের ঝামেলা বিবাদ নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতে চেষ্টা করবেন। অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলবেন না। মনকে বোঝান। আর নিজেদেরকে একটু বেশি সময় দিন। একবার যদি আপনারা একে অপরকে বুঝতে শুরু করেন তাহলে দেখবেন সম্পর্কে ভালোবাসা বাড়ছে। আর সম্পর্কে সবসময় শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখবেন।
সব কথার শেষ কথা
লাভ ম্যারেজ আর এরেঞ্জ ম্যারেজ যেটাই বলি না কেন, দুটোরই ভালো ও খারাপ দিক আছে। বৈবাহিক জীবনের সাফল্য থাকে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই হাতে। নিজেদের মনে সুখ না থাকলে লাভ ম্যারেজ কিংবা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ- কোনোটাতেই সুখী হওয়া যায় না। পারস্পরিক সম্মান, ভালবাসা, সততা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা, এই উপাদানগুলির মাধ্যমেই বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী হয়। নবদম্পতিদের মধ্যে বোঝাপড়া ভাল হলে প্রত্যেক দাম্পত্য জীবনেই সুখ থাকে এবং জীবন হতে পারে আরও মধুময়।
কল করুনঃ+880-1407-004393 অথবা +88-01782-006615 এ।
আমাদের মেইল করুন taslima55bd@gmail.com